হাসান আলী॥ দেশের বৃহৎ চালের মোকাম খ্যাত কুষ্টিয়ার খাজা নগরে গত একমাস ধরে কোন কারণ ছাড়াই সব রকম চালের কেজি প্রতি দাম বেড়েই চলেছে। কখনই নি¤œগামী নয় কেবলই উর্দ্ধগামীর অস্থিরতা চরম উদ্বিগ্নের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা নিষ্ক্রীয় বা দুর্বল বাজার মনিটরিংকে দায়ী করছেন। এতে নিদারুণ নাভিশ^াসে দিন কাটছে চাল ভোক্তাদের। বাজার মনিটরিংয়ে কোন ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন জেলা প্রশাসক।
সরেজমিন অনুসন্ধানে, বাংলাদেশ ধান গবেষনা, পরিসংখ্যান, বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ, খাদ্য বিভাগ, কৃষিবিদ, পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, কৃষক, চালের পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে চিত্র উঠে এসেছে, সেখানে খুচরা বিক্রেতা পাইকার আড়তদারকে, পাইকার মিলারকে, মিলার মধ্যস্বত্ত্বভোগী মজুতদার, পাইকার আড়ৎদার ও নিষ্ক্রীয় বাজার মনিটরিংকে, মজুতদার কৃষককে দুষছেন। তবে ধান উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ধান গবেষনা, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএডিসি এবং কৃষকের অভিযোগ, ‘ভেঙ্গে পড়েছে দেশের চাল বাজার নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, বাজার মনিটরিং কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রীয়তার সুযোগ নিয়ে মূলত: মিলার বা চাল উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট নানা প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দেশের চাল বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়েছেন। ফলে প্রতিদিন প্রতিক্ষনে চালের বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে কোন কারণ ছাড়াই’।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘চলতি মৌসুমে সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষিরা শ্রমিক সংকটের কারনে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েছিলো এবং হাওড়াঞ্চলের ধান ডুবে যাওয়ায় শুধুমাত্র চলতি মৌসুমে মোট ধান উৎপাদনক্ষমতার ২০শতাংশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এতে বার্ষিক ধান ও চাল উৎপাদনে এমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না যা দেশকে খাদ্য ঘাটতির মুখে ঠেলে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। তারা বলছেন দেশের মোট খাদ্য চাহিদার তুলনায় এমনিতেই উদ্ধৃত্ত অবস্থানে আছে দেশের বিদ্যমান খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটও দেশের অন্তত এই খাদ্য পরিস্থিতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারবেনা বলেই তাদের দাবি। সেই সাথে তারা শংকা প্রকাশ করছেন যে, উদ্ভুত বিভিন্ন ইস্যুকে পুঁজি করে ইতোপূর্বেও দেশের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অধিকাংশ ক্ষেত্রে খোঁড়া যুক্তিতে বাজার মূল্য উর্দ্ধমূখী করে তোলার প্রবনতা আছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের ত্রুটিপূর্ন বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজার মনিটরিং সেলের নিষ্ক্রীয়তার কারনকেই চিহ্নিত করছেন চালের বাজারকে অস্থির করে তোলার পিছনে।
কুষ্টিয়া বড় বাজারের চাল ব্যবসায়ী মজনু সেখ বলেন, বর্তমানে মিনিকেট চাল ৬৪ টাকা কেজি, কাজললতা ৫৬ টাকা, বাসমতি ৭৬ টাকা, কাটারীভোগ ৭২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৮ টাকা ও স্বর্ণা বা সব ধরনের মোটা চাল ৪৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বোরো ধানের ভরা মৌসুমেও অস্থির কুষ্টিয়ার চালের বাজার। সব ধরনের চালের দামই উর্দ্ধমুখী। গত এক মাসেরও কম সময়ে কুষ্টিয়ার খাজানগরের মোকামে এক এক করে পাঁচ দফায় চালের কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ৫-৬ টাকা। কয়েকদিন আগেও কুষ্টিয়ার খাজানগর মিল গেটে মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তা যেখানে তারা ২হাজার ৮শ টাকায় বিক্রী হয়েছে, এখন সেই মিনিকেট ৩হাজার ১শ টাকায় বিক্রী হচ্ছে। এভাবে সব রকম চালের দাম মিল গেটেই উর্দ্ধমুখী।
চালের দাম বৃদ্ধির সত্যতা স্বীকার করে কুষ্টিয়া জেলা বাজার কর্মকর্তা আব্দুস সালাম তরফদার বলেন, “এই সময়ে অযৌক্তিক ভাবেই একটি অসাধু চক্র চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বিষয়টি আমি আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকেও অবগত করিয়েছি। তাছাড়া কোন অসাধু চক্র এর সাথে জড়িত থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব কেবলমাত্র আমার একার নয়; এখানে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, খাদ্য অধিদপ্তরেরও দায় আছে”।‘এরচেয়ে বেশী কিছু আমি বলতে পারবোনা, আরও কিছু জানার থাকলে আমার অফিসে আসেন, আপনি আদৌ কোন সাংবাদিক কি না সেটাও আমার জানার দরকার আছে।”
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সাধুর অভিযোগ, ‘এখন ধানের ভরা মৌসুম। এটাকে সদ্ব্যবহার করে হঠাৎ উদয় হওয়া এক শ্রেনীর অসাধু মধ্যস্বত্ত্বভোগী মৌসুমী মজুতদার ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে কোয়ালিটি ধান সব তুলে নিয়ে গুদামজাত করে ফেলেছেন। বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট সৃস্টি করে ইচ্ছেমতো দর হাকছেন তারা। আমরা মিলাররা মিল চালু ও চালের উৎপাদন অব্যহত রাখার স্বার্থে মজুতদারদের বেধে দেয়া দামেই ধান কিনতে বাধ্য হচ্ছি। চাল উৎপাদন কোন ভাবেই বন্ধ রাখা যাবে না। কারণ দেশের চালের বাজারে মোট চাহিদার ৪০শতাংশ চাল সরবরাহ হয়ে থাকে খাজানগর মোকাম থেকে।’
আপনারা প্রশাসনকে বলেন, ‘যে কোন মূল্যে এদের রুখতে না পারলে চালের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। চলতি মৌসুম হলো চিকন ধানের মৌসুম, অথচ এই সময়ে মজুতদারদের কাছ থেকে প্রতি মন ধানের উপর ১শ থেকে দেড়শ টাকা বেশী দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সাড়ে ১২ শ টাকা মন ধান এখন সাড়ে ১৩শ বা ১৪শ টাকা মনে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে এবার একটা উল্লেখযোগ্য পরিমান চিকন ধানের গুনগত মানে ক্ষতি হওয়ায় শুরুতেই ধানের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। চাল তো আর বাতাস থেকে হয়না, ধান থেকে চাল হয়, ধানের বাজার উর্দ্ধমূখী হলে চালের দাম ঠিক থাকবে কি করে ?” আমরা গত এক সপ্তাহ পূর্বে যে চিকন চাল মিল গেটে কেজি পতি ৫৮/৫৯টাকা ছিলো এখন সেই চাল মিল গেটেই বিক্রী হচ্ছে কেজি প্রতি ৬২টাকা দরে। পাইকাররা মিলগেট থেকে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের লাভ রেখেই বাজারে ছাড়ছে। যতদুর জানি খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিকন বা সরু চালের দর এখন ৬৮ থেকে ৭০টাকা। প্রতিবারই চালের বাজার দরে অস্থিরতা দেখা দিলেই সবাই মিলারদের দোষ দেন। অথচ চালের বাজারে কারসাজি করতে এখন নানা মহল নানা ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।’
চাল মিলারদের দেয়া তথ্য সূত্রে জানা যায়, ধান কেনার পর সব ধরনের খরচ সংযোজনসহ চাল বাজারজাত পর্যন্ত প্রতি ১মন চাল উৎপাদন খরচ হয় ১১০ থেকে ১৩০টাকা বা কেজি প্রতি চালের উৎপাদন খরচ হয় ২.৮০টাকা। তবে ১মণ ফ্রেস চাল উৎপাদন শেষে কালো চাল, খুদ, কুড়া, ভুষি এবং রাইসব্যান পলিসের মতো বায়ো প্রডাক্ট থেকে আয় হয় ১শ ৫০ থেকে ২শ ৫০ টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএডিসি কুষ্টিয়ার উপপরিচালক (বিজ বিপনন) আব্দুর রহমান বলেন, ‘সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে উৎপাদন খাতে কৃষি যান্ত্রিকীরন, সেচ, সার ও বীজ সরবরাহ ছাড়াও নানামুখী প্রনোদনা দিচ্ছেন। বিএডিসি মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের মাঝে সেসব প্রনোদনা পৌছে দিচ্ছি। নানাভাবেই সরকারী ভাবে নেয়া উদ্যেগের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল একসময়ের বিঘাপ্রতি ৪মন ধান উৎপাদনের জমিতে এখন বছরে প্রায় ১শ মন ধান উৎপাদন সক্ষম হয়েছে।’ অথচ অসাধু চালকল ও ব্যবসায়ী চক্রে কাছে আমাদের চাল বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে দুর্বল বাজার মনিটরিংয়ের কারনে, যে কারণে চালের বাজার মূল্য নিয়ে প্রায়ই আমাদের শংকার মধ্যে থাকতে হচ্ছে, এটা কোনভাবেই কাম্য নয়।’
মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের কৃষক রাইহানুল বলেন,‘ আমার ৭বিঘা জমিতে বছরের তিন বতরে (মৌসুম: আউশ আমন ও বোরো) ধারন হচ্ছে ২শ মনের উপরে। এক বতরের ধান উঠার সাথে সাথে সেগুলি বিক্রি করে সেই টাকায় আবার পরের বতরের ধান লাগনো আর্থিক প্রস্তুতি নিতে হয়। তাছাড়া আপনারা গ্রাম ঘুরে দেখেন দেখি কোন চাষীর ঘরে নিজের খাওয়ার ধান ছাড়া বেশী ধান বাধায় করা আছে?’ মিল মালিকদের সাথে সম্পর্ক কইরি একদল ফইরিরা ধান উঠার সাথে সাথে বাড়িতি আইসি নিয়ে যাচ্ছে।’ মৌসুমের ধান মাঠ থেকে উঠার পর ১০/১৫দিনের মধ্যিই সব ধান চলি যাচ্ছে মিলয়ালাদের গোডাউনে।’ মাঠের সব ধান গোডাউনে ঢোকার সাথে সাথেই ধান এবং চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে চাষীদের কোন লাভ নেই। বরং সরকারের বেধে দেয়া ১হাজার ৫০টাকা প্রতিমন হিসেবেই যদি চাষীরা ধান বেচার গিরান্টি পাই তাতেই খুশি।’
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপ পরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামানিক জানান, ‘সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিলো ৩ কোটি ৭৬লক্ষ ৬০হাজার মে:টন যা চলতি অর্থ বছরেও লক্ষমাত্রা অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে। একই ভাবে কুষ্টিয়া জেলায় গত অর্থ বছরে(২০২০-২০২১) আউশ আমন ও বোরো মৌসুমে মোট চাল উৎপদান হয়েছিলো ৫ লক্ষ ৩৫হাজার ৭শ ৪৭ মে:টন, যা চলতি অর্থ বছরেও(২০২১-২০২২) ৫ লক্ষ ৪০হাজার ৬শ ৬৯ মে:টনে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার অর্জন দাঁড়িয়েছে।’ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা এই ৫টি জেলারও ধান উৎপাদন পরিস্থিতি বিগত মৌসুমের মতই অপরিবর্তিত আছে বলেও জানালেন এই কৃষি কর্মকর্তা। বিদ্যমান অবস্থায় দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধুমাত্র বাজার মনিটরিংকে শক্তিশালী ও কার্যকরী করা গেলে সরকারকে বিচলিত হওয়ার কোন কারন নেই বলে মনে করেন তিনি।
কোন প্রকার যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দুর্বল বা নিষ্ক্রীয় বাজার মনিটরিংয়ের কারণে দেশের বৃহৎ চালের মোকাম কুষ্টিয়া খাজানগরে চালের বাজার মূল্যে বেশকিছুদিন ধরেই চলমান অস্থিরতা, সংশ্লিষ্টদের এমন অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবাইকে ডেকেছি, বিষয়টি নিয়ে বিশদ কথা হবে সেখানে। চালের বাজার অস্থিরতার নিরসনে বাজার মনিটরিংএ কোন ত্রুটি কিংবা দুর্বলতা থাকলে তা খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’