
যে কোনো সম্পর্কের মতো বন্ধুত্ব জীবন ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য দরকার। তবে সেই বন্ধুত্বে যদি দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা তখন কী করবেন? ছেড়ে দেবেন নাকি সম্পর্ক ঝালাইয়ের চেষ্টা চালাবেন?
ঝগড়া-ফ্যাসাদের চাইতে অন্য পথ বেছে নেওয়া সহজ আর আকর্ষণীয়। কারণ দ্বন্দ্ব কঠিন, আর এড়িয়ে যাওয়া সহজ। তবে একাকী হওয়ার ভয়ও কাজ করে।
এই বিষয়ে মার্কিন বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখক লিডিয়া ডেনওর্থ তার ‘ফ্রেন্ডশিপ: দি ইভোলিউশন, বায়োলজি অ্যান্ড এক্সট্রাঅর্ডিনারি পাওয়ার অফ লাইফ’স ফান্ডামেন্টাল বন্ড’ বইতে লেখেন, ‘এটা আসলে জীবন মৃত্যুর মতো টানাটানির ব্যাপার।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “একা থাকা সম্ভব না। অন্যজনের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা আমাদের ডিএনএ’তেই রয়েছে। মানে হল বন্ধুত্ব বিলাসিতা নয়। বরং সার্থক ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য এই সম্পর্কের প্রয়োজন।”
যদি কোনো বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়, বা যোগাযোগ কমে যায়- সেটা পুনরুদ্ধারের নানান পন্থা আছে। আর নিজের যত্ন নেওয়ার মতোই বিষয়টাকে ভাবা যেতে পারে।
ভালো বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করা
“বন্ধুর সঙ্গে কঠিন আলাপে যাওয়ার আগে একটু ভাবুন তার সঙ্গে কোন বিষয়গুলো আপনার মধ্যে আনন্দ নিয়ে আসতো” মার্কিন লেখক অ্যাডাম স্মাইলি পজওস্কি এই পরামর্শ দেন তার ‘ফ্রেন্ডশিপ ইন দ্য এইজ অফ লোনলিনেস’ বইতে।
“তারপর সেগুলো লিখে রাখুন খাতায়। আর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় সেগুলো উল্লেখ করুন”- বইতে লেখেন এই যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জনপ্রিয় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’।
“সম্পর্ক সারাই করতে গিয়ে শুরুতে ইতিবাচকতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আলাপ অনেক অর্থবহ হয়”- সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এভাবে পরামর্শ দেন তিনি।
ফলাফল যাই হোক, ইতিবাচক উদ্দেশ্যের প্রভাটা থেকে যাবে।
পজওস্কি বলেন, “এমনকি সম্পর্কে টানটান অবস্থা থেকে গেলে বা বন্ধুত্বে আপাতত বিরতি কিংবা একেবারেই আর যোগাযোগ বন্ধ হলেও এই ইতিবাচকতার জন্য একে অপরের প্রতি সহানুভূতিটা থেকে যাবে।”
যোগাযোগের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন
প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলে অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
পজওস্কি বলেন, “মানুষ এখনও হাতে লেখা চিঠি পেলে উত্তেজিত হয়। অথবা পাঠানো যেতে পারে পোস্টকার্ড বা বই।”
সাথে গভীরভাবপূর্ণতার সাথে লেখা চিঠি যোগাযোগের এই মাধ্যমকে আরও অর্থবহ করে তুলবে।
কথা বলার আগে চিঠিতে উল্লেখ করতে হবে কেনো এই যোগাযোগহীনতার জন্য খারাপ লাগছে, আর কোনো সম্পর্কটা মেরামত করতে চাচ্ছেন। এই অভিপ্রায় প্রকাশে সহানুভূতি জাগাতে সাহায্য করবে আর কথা বলায় সুবিধা হবে।
পজওস্কি বলেন, “হয়ত জানতে পারবেন বন্ধু অন্য কিছু ভেবে বসে আছে, আপনি হয়ত সেটার সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারেননি। মুখোমুখি বসার আগে অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা গুরুত্বপূর্ণ।”
সময় দিন এবং আবার চেষ্টা করুন
বিরোধের মুখোমুখি হতে একেকজন একেক রকম আচরণ করেন। তাই একবার চেষ্ট করার পর, পরের বার চেষ্টা করার মাঝে যথেষ্ট নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় দিতে হবে।
ওয়াশিংটন ভিত্তি মনোবিজ্ঞানি ও বন্ধুত্ব-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মারিয়া ফ্রাঙ্কো একই প্রতিবেদনে বলেন, “বন্ধুত্বে দ্বন্দ্বের পর থিতু হতে সময় লাগতে পারে। আর অস্বস্তিকর অনুভূতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।”
“এখনও যদি অস্বস্তি কাজ করে তবে বুঝতে হবে, সবাই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে প্রস্তুত না” বলেন ফ্রাঙ্কো।
সৎ আর দৃঢ়ভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ‘আমাদের ঝগড়ার পর সত্যি নিজের কাছে খারাপ লাগছে। আমি চাই বন্ধুত্বের মূল্য দিতে। আস বরং কথা বলে আমার মিটমাট করে ফেলি।’
ফ্রাঙ্কো বলেন, “আরও মনে রাখতে হবে, আপনার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই করতে পারেন। যদি বন্ধুটি সাড়া না দেয়, তবে অন্তত নিজেকে নিয়ে গর্ব করতে পারবেন যে- আপনার দিক থেকে চেষ্টার অন্ত ছিল না। মনে রাখতে হবে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু নিজের দিক থেকে আপনি অন্তত সৎ চেষ্টা করেছেন।”
‘বন্ধুত্বের আসবাব’ পরিবর্তন
দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে মনে করা হয়, আমরা একই রকম আছি। তবে বাস্তবতা হল আমাদের অগ্রাধিকার ও পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল।
বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যায় সম্পর্কটা আর আগের মতো হচ্ছে না, তবে ডেনওর্থ পরামর্শ দেন, “এক্ষেত্রে বন্ধুর সঙ্গে আরও সাধারণ বা ‘ক্যাজুয়াল’ পন্থা অবলম্বন করতে হবে।”
“আমি এই পদ্ধতির নাম দিয়েছি সামাজিক জীবনের আসবাবপত্রের পরিবর্তন” বলেন ডেনওর্থ।
তার কথায়, “বন্ধুত্ব আজীবন স্থায়ী হয় না। আর সেটা স্বাভাবিক। বিবর্তন-বিষয়ক জীববিজ্ঞানিরা দেখেছেন উন্নত বন্ধনের জন্য তিনটা জিনিস প্রয়োজন- দীর্ঘস্থায়ী, ইতিবাচক ও সহযোগী। আর বন্ধুত্বের জন্য এই তিন উপাদান অবশ্যই প্রয়োজন।”
বিপজ্জনক লক্ষণগুলো খেয়াল করা
অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি থেকে বন্ধুত্বে সংঘাত হয়। আবার কোনো সময় দেখা যায় সমস্যা অনেক গভীর।
ফ্রাঙ্কো পরামর্শ দেন, “মাত্র একটা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বন্ধুত্ব নষ্ট করা উচিত না। বরং দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ার মানে হল সম্পর্কের পুনঃমূল্যায়ন ও উন্নত করার রাস্তা খুলে যাওয়া। আর সেটা দুই পক্ষকেই করতে হবে।”
তবে তিনি বিপজ্জনক লক্ষণগুলোর দিকেও নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন।
তার কথায়, “যদি দেখা যায় ভালোর চাইতে খারাপ বেশি হচ্ছে, যেমন- বন্ধু যদি আপনার সফলতা নিয়ে সমালোচনা করে, বাজে কথা বলে, ভুল বোঝা চলতেই থাকে অথবা তার আচরণ আপনার মধ্যে মাথা নিচু হওয়া বা মন খারাপের অনুভূতি জাগায়- তবে সেই সম্পর্ক থেকে সরে আসাই হবে উপকারী সিদ্ধান্ত।”
ভালো এবং ক্ষতির দিকটা হিসাব করা জরুরি।
ডেনওর্থ বলেন, “বন্ধুত্বের বিজ্ঞানে দেখা গেছে, দোদুল্যমান বা পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। অন্যভাবে বলা যায়, যেখানে ভালোর চাইতে খারাপ বেশি সেখানে ভালো বিষয় কোনো ওজন বহন করে না।”
তাই অতীতে ভালো সময় কেটেছে এই কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরি।